ড. আহসান এইচ মনসুর সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এর আগে তিনি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের ত্রয়োদশ গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক এ চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে লেখাপড়া করে শিক্ষক হিসেবে সেখানেই পেশাজীবন শুরু করেছিলেন। কিছুদিন পর অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডা চলে যান। ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। পিএইচডি চলাকালে ১৯৮১ সালে তিনি অর্থনীতিবিদ প্রোগ্রামের অধীনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে যোগ দেন। আইএমএফে দীর্ঘ কর্মজীবনে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে তিনি কাজ করেছেন। আইএমএফের ফিসকাল অ্যাফেয়ার্স এবং পলিসি রিভিউ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগেও কাজ করেছেন। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন আহসান মনসুর।
মাঝে ১৯৮৯ সালে তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী ওয়াহিদুল হকের অর্থ উপদেষ্টা হন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের বিভিন্ন দিক এবং সংস্কার নিয়ে সঙ্গে কথা বলেন
নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে তাদের কোন দিকগুলোতে নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশে খুব দ্রুত একটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যাবে, সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। ফলে কোনো কিছুই পরিকল্পিত নয়। আমাদের অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো চলছে, সেগুলো বহুদিন ধরেই চলে আসছে। বিগত সরকার এ সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে আসছিল, অনেক সমস্যা ইচ্ছাকৃতভাবেও তৈরি করা হয়েছিল। লুটতরাজ, ঋণখেলাপিসহ অনেক সমস্যাই ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিত। ফলে নতুন এ সরকারকে অনেক দিকই সামাল দিতে হবে।
সর্বপ্রথম এ সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে এবং এর সঙ্গে আর্থিক খাতের দৃশ্যমান বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখানে আমি অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কথা বলছি না বরং বাহ্যিক বিশৃঙ্খলা যেমন রাস্তাঘাটে গোলাগুলি, একপক্ষ আরেকপক্ষের ওপর হামলা, বাজার নিয়ন্ত্রণ এসব বিষয়ের কথা বলছি। সম্প্রতি একটি ব্যাংকে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সেটি অপ্রত্যাশিত, তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই এটা হয়ে থাকে। আমি মনে করি, এগুলো খুব দ্রুতই সমাধান করা সম্ভব।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার কীভাবে হতে পারে বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: অর্থনৈতিক খাতের সমস্যাগুলোকে আমি মূলত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে চাই। প্রথমত, অর্থনৈতিক খাতের রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমেই এর বিশুদ্ধকরণ প্রয়োজন। পরবর্তী সরকার যেন আরেকটি স্বৈরাচারে পরিণত না হয়, সেজন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এই মুহূর্তে নির্বাচন দিয়ে দিলে এই অন্তর্নিহিত সমস্যার সমাধান হবে না। আজ এক পরিবার রয়েছে, এ পরিবার গেলে কাল আরেক পরিবার আসবে এবং বাংলাদেশ এই পরিবারতন্ত্র থেকে বের হতে পারবে না। এখান থেকে বের হতে গেলে কিছু ফান্ডামেন্টাল পরিবর্তন আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেকটি সার্ভিস সেক্টরকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে নিজ দখলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভূমি অফিসে এক হাজার টাকায় যে সেবা পাওয়ার কথা সেখানে চাওয়া হবে ১ লাখ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে ৫-১০ লাখ টাকা। আর এটা তারা করছে কারণ তাদের হাতে ক্ষমতা আছে। এটা ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। আমি পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেছি, দেখা যাবে তাতে ভুল রয়েছে। এটা তারা ইচ্ছে করে কি না, আমি জানি না। তবে এই ভুল সংশোধন করতে আমাকে চরম আর্থিক এবং মানসিক হয়রানির শিকার হতে হয়। এভাবে প্রতিটি সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। দেশে যে সরকারি সেবাগুলো বিনামূল্যে পাওয়া উচিত সেগুলো জনগণকে উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। আর এভাবে চলতে চলতে দেশের জনগণ চরমভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমি পশ্চিমা দেশগুলোতে পেশাগত কারণে ৩২ বছর বসবাস করেছি। সেখানে কোনো দিন আমাকে কোনো সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়নি। ৩২ বছরে কোনো দিন কাউকে বলতে হয়নি, এখানে এই কাজ হবে না। আমি একবার সেখানকার একটি ভূমি অফিসে গিয়েছিলাম। গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে দেখলাম সেখানে লেখা রয়েছে, ১৫ মিনিটের জন্য গাড়ি পার্ক করতে পারবেন। আমি ভাবলাম, আজ আর আমার কাজটি হবে না। আমি শুধু অফিসটা চিনে চলে যাব। কারণ আমার হাতে সময় ১৫ মিনিট। আমি অফিসে ঢুকলাম, আমার ঠিকানা দিয়ে আমি একটি জমির দলিলসংক্রান্ত কাজের কথা বললাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম কত সময় লাগবে? তারা আমার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় নিল। আমি নির্দিষ্ট জায়গায় ফি জমা দিয়ে আসলাম। এর মধ্যে আমার কাজ হয়ে গেছে। আমি দেখলাম আমার হাতে এখনো ৭-৮ মিনিট সময় রয়ে গেছে।
অথচ আমি যদি বাংলাদেশের কোনো একটি ভূমি অফিসে গেলে কী হতো? বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি সেবায় যেভাবে দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে, সেখান থেকে জনগণ মুক্তি চায়। সরকারি সেবা প্রাপ্তির পথ সুগম হলে জনগণ সব থেকে বেশি খুশি হবে। থানায় গেলে ঘুষ দিতে হয়, ঘুষ না দিলে এফআইআর হবে না এটাই আমার ফান্ডামেন্টাল রাইটসকে চ্যালেঞ্জ করছে। সরকার যদি এ জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারে তাহলে আমি মনে করি এ দেশের মানুষ সারা জীবন এই সরকারকে মনে রাখবে। আমি মনে করি চাইলেই এটা সম্ভব।
আহসান এইচ মনসুর: অবশ্যই সম্ভব। সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সেটা তদন্ত করে দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি একাধিক ব্যক্তি একই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে তাকে বহিষ্কার করতে হবে। সরকার যদি এমন কঠোর অবস্থান নিতে পারে তাহলে এ দেশটা আমূলে বদলে যাবে।
যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তারাই বিদেশে টাকা পাচার করে। দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে টাকা পাচারও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের রিজার্ভ সংকট অনেকাংশে কমে আসবে। সামাজিক ভারসাম্য ফিরে আসবে। এখন দেখা যায়, একজন ছোটখাটো কর কর্মকর্তার ঢাকা শহরে পাঁচটি বাড়ি। রাজউকের একজন পিয়নেরও দশটি বাড়ি, ১০০ কোটি টাকার মালিক। কীভাবে তারা এই অর্থ উপার্জন করছে? আমাদের সমাজকে এ জায়গাটা থেকে বের করতে হবে। দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। এ সমাজকে বাঁচাতে হবে।