Monday, March 31, 2025

হাসিনাকে অপমান করে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়ার পর ড. ইউনূসকে যে সম্মান দিল চীন

আরও পড়ুন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর চীন দ্রুত নবগঠিত ইউনূস সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর গত বছরের ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশে আসে, যা দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, হাসিনা সরকারের পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে সক্রিয় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক শুরু করে এবং তাদের প্রতিনিধিদের চীনে আমন্ত্রণ জানায়, যা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আভাস দিচ্ছে। এই ধারাবাহিক কূটনৈতিক অগ্রগতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হলো প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর।

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর অন্যান্য সময়ের তুলনায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীকে পুনর্বাসনে ভারতের অব্যাহত ষড়যন্ত্র, সীমান্তে নিরপরাধ বাংলাদেশিদের নির্বিচার হত্যা এবং ন্যায্য পানির হিস্যা না পাওয়ার কারণে জনমনে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দিন দিন বেড়ে চলছে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে অবস্থান করছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আরও পড়ুনঃ  সাবেক ১৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান

শেখ হাসিনা ডামি নির্বাচনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে চীনে গিয়েছিলেন। চীনের সফর নিয়ে সে সময়ে অনেক জল্পনা কল্পনা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছুই হয়নি। প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি ছিল খুবই কম। চীন হাসিনাকে তেমন কোনো অর্থ সহায়তার আশ্বাস দেয়নি। চীনের প্রেসিডেন্ট তাকে সাক্ষাতও দেননি। অনেকটা বাধ্য হয়েই সফর সংক্ষেপ করে একদিন আগেই হতাশ হয়ে দেশে ফিরেছিলেন সাবেক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা।

তার এই আগেভাগে ফেরা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের আলোচনাও হয়েছিল তখন। কেউ বলছিলেন, টাকা না পাওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরেছেন হাসিনা, কেউ বা বলেছিলেন দেশের পরিস্থিতি শামাল দিতে হাসিনা সফর সংক্ষেপ করেছেন। আর কেউ কেউ সফর সংক্ষেপের নেপথ্যে পারিবারিক ঝামেলা বা ব্যক্তিগত ক্রাইসিসের কথা বলেছিলেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনার পতনের পর চিত্র পাল্টে যায় অনেক। চীনের আমন্ত্রণে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রায় সব দলের নেতারাই চীন সফর করেছেন। আর এই মুহুর্তে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সেখানে আছেন। এরই মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বের এই মুহুর্তে অন্যতম প্রভাবশালী নেতা শি জিন পিং এর সাথে ইউনূস সাহেবের দেখা হয়েছে।

হাসিনাকে যে শি জিন পিং দেখাই দেননি, তিনি এবার ড. ইউনূসের সাথে যেভাবে বৈঠক করেছেন তা বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশ্লেষকরা এখন এসে এমনও দাবি করছেন যে, চীন বুঝতে পেরেছিল যে, আওয়ামী সরকার বেশিদিন স্থায়ী হবে না আর সে কারণেই তারা হাসিনার পেছনে নতুন করে আর অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়নি।

আরও পড়ুনঃ  ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বৈধতা দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট

এছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর হওয়াটাই একে বিশেষভাবে তাপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। প্রধান উপদেষ্টার সফরটি ভূ-রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরের গন্তব্য বরাবরই ছিল নয়া দিল্লি।কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর হয় চীনে, গত জানুয়ারিতে।

ড. ইউনুসের চীন সফরে যা পেল বাংলাদেশ এই সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি এবং আটটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার চার দিনের চীন সফরের আজ শুক্রবার তৃতীয় দিনে দুই দেশের মধ্যে এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও স্মারকগুলো সই হয়।

সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে দুই দেশের কালজয়ী সাহিত্য ও শিল্পকর্মের অনুবাদ ও সৃজন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও খবর আদান-প্রদান, গণমাধ্যম, ক্রীড়া এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিময় সহযোগিতা। এর পাশাপাশি, প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপাক্ষিক চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে পাঁচ বিষয়ে সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  জাতিসংঘ শূন্য বর্জ্য দিবসে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি

এগুলো হলো- বিনিয়োগ আলোচনা শুরু করা, চীনের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু, মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ, একটি রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং একটি কার্ডিয়াক সার্জারি গাড়ি অনুদান।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকালে বাংলাদেশ চীনা সরকার ও সেই দেশের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এই প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা ও ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানান, প্রধান উপদেষ্টা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানোর পর প্রায় ৩০টি চীনা কোম্পানি চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলি আহমাদ মাবরুর লিখেছেন, শি জিন পিং আজকের বৈঠকে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ড. ইউনূসের সরকার যেভাবে দেশের ওপর ধারাবাহিকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছেন তাতেও তিনি সন্তুষ্টি জানিয়েছেন। এরপর চীনের ব্যবসায়ীদের সাথেও বৈঠক হয়েছে ড. ইউনূসের। সবমিলিয়ে চীনে ড. ইউনূসের সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যে ভারতের আধিপত্য থেকে ক্রমশ বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, এই সফরের মাধ্যমে ড. ইউনুস সে বার্তাও বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে দিয়েছেন। এটি একটি মেজর শিফট।

সর্বশেষ সংবাদ