যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই পশ্চিমাদের সঙ্গে ন্যাটোতে মার্কিন অংশগ্রহণ কমানোর ঘোষণা দেন। এরপরই নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে একজোট হয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এ পরিস্থিতিতে ইইউভুক্ত দেশগুলো পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পারমাণবিক অস্ত্রে বিনিয়োগের পরিবর্তে, ইইউ প্রতিরক্ষাকে আরও দক্ষ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে রাশিয়াকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর যৌথ নিরাপত্তা সংস্থায় একীভূত করে তোলাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন মার্কিন নীতির ফলে আমেরিকান সৈন্য বা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র প্রত্যাহার করা হলে অঞ্চলটিতে আধিপত্য বিস্তার করবে ফ্রান্স। যুক্তরাজ্যকেও এই প্রতিযোগিতায় পাশাপাশি রাখা হচ্ছে। ফলে ফরাসি এবং ব্রিটিশ পারমাণবিক অস্ত্রের ইউরোপীকরণ যেকোনভাবেই বাস্তবে পরিণত হতে পারে। এছাড়া নতুন মার্কিন নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ বছরের পররাষ্ট্রনীতি ভেঙে পড়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। যদিও ইউরোপে এখনো এক লাখ মার্কিন সৈন্য এবং ১০০টি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
আমেরিকার এই অস্ত্রগুলো তুরস্ক, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়ামে মোতায়েন রয়েছে। যদি সৈন্য বা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে ইউরোপে ফ্রান্স ও বিৃটেনের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ইউরোপীকরণ সহজ হবে।
ইউরোপের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যা প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইউরোপ বেশকিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এমন সম্ভাবনা বাস্তবায়ন হতে পারে। এরমধ্যে ইউরোপীয় পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলোকে তাদের “জাতীয় স্বার্থ”-কে “ইউরোপীয় স্বার্থ” হিসেবে সংযুক্ত করা (লিসবন চুক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে) এবং ন্যাটোর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের অনুরূপ একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ধারা প্রয়োজন। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য তথ্য বিনিময়, পরামর্শ, যৌথ পরিকল্পনা, যৌথ অনুশীলন এবং সহ-অর্থায়নের মতো আরও কিছু বিষয়কে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এছাড়া জার্মানি বা পোল্যান্ডে ফরাসি ডুয়েল ক্যাপাবল এয়ারক্রাফট (ডিসিএ) বা ফাইটার জেট মোতায়েন করা যেতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, চূড়ান্ত পদক্ষেপ হবে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ইউনিয়নে (ইডিইউ) একটি ইউ-পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। তবে, এখন দেখার বিষয় ইউক্রেন যুদ্ধ এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে কতটা সহায়ক হয়।
ইউরোপীকরণে পারমাণবিক অস্ত্রের রাজনীতি
পারমাণবিক অস্ত্র যে কোনো হামলা প্রতিরোধ ক্ষমতা হিসেবে কাজ করে এমন ধারণা অনিশ্চিত। অনেক পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র (ইসরায়েল, ভারত, যুক্তরাজ্য) বিভিন্ন অ-পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের দ্বারা আক্রমণের স্বীকার হয়েছে। তবে এটি যে অন্যতম বিধ্বংসী অস্ত্র তা নিয়ে দ্বিধা নেই।
এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুধু একটি অঞ্চল বা দেশ নয়, পুরো একটি গ্রহকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ জন্য ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেনে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলেও, ফ্রান্স পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে প্রতিশোধ নেবে না।’
এদিকে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি অত্যাধুনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তথাকথিত পারমাণবিক স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এই অস্ত্র পারমাণবিক প্রতিরোধকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। তাই বেশি অর্থ ব্যয় করে পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সংশয় রয়েছে।
এর বাইরেও ইউরোপে পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশ কিছু আলোচনা রয়েছে। এর অন্যতম বিষয় হলো—ইডিইউ না থাকা পর্যন্ত কে ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণ করবে? যদিও ম্যাক্রোঁ স্পষ্ট করেছেন, ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই থাকবে। এমনটি হলে জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের করদাতারা সহ-অর্থায়নে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে দিতে আগ্রহী হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এছাড়া ফরাসি পারমাণবিক অস্ত্রের ইউরোপীকরণের মাধ্যমে, ইইউ পারমাণবিক অস্ত্রকে বৈধতা দিলে এই অস্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াইকে জটিল করে তুলবে। ইইউ যখন নিজেই পারমাণবিক অস্ত্রাগার স্থাপন করছে তখন ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার জন্য অনুরোধ করা কতটা টেকসই হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা যদি ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার চেয়ে রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বেশি সময় ব্যয় করেন, তবে অনেক ভালো হবে। তাদের মতে, ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করার এখনই উপযুক্ত সময়, কেবল মানবিক কারণেই নয়, অর্থনৈতিক কারণেও। এমন একটি সম্পর্কে পৌঁছানো গেলে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষাকে আলাদা আলাদা সামরিক বাহিনী সৃষ্টি থেকে বিরত রাখা সম্ভব।
বর্তমানে ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিরক্ষায় ৪৮৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, যা রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। তাই গণবিধ্বংসী অস্ত্রে বিনিয়োগের পরিবর্তে, ইইউ প্রতিরক্ষাকে আরও দক্ষ করে তুলতে মনোনিবেশ করলে এবং রাশিয়াকে একটি বৃহত্তর যৌথ নিরাপত্তা সংস্থায় একীভূত করলে ইউরোপের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাঠামোও শক্তিশালী হবে।