Sunday, March 16, 2025

বাংলাদেশ সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কী বার্তা দিলেন?

আরও পড়ুন

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তার এই সফর ছিল অত্যন্ত কর্মব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সফরে তিনি বাংলাদেশ সরকারের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া, রোহিঙ্গা সংকট এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সফরের শেষে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে তার অভিজ্ঞতা ও জাতিসংঘের অবস্থান তুলে ধরেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় পৌঁছান এবং টানা দুই দিন বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। সফরের মূল লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ, বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং জাতিসংঘের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা। তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার শরণার্থীদের সাথে ‘সলিডারিটি ইফতার’ করেন। পরদিন শনিবার তিনি ঢাকায় জাতিসংঘের নতুন ভবন উদ্বোধন করেন এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব জানান, বাংলাদেশ সরকার যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে জাতিসংঘ সহযোগী হতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, শান্তি বজায় রাখতে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের এক নম্বর সহযোগী হিসেবে গণ্য করতে পারেন আপনারা।” তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে একটি ন্যায্য ও টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে জাতিসংঘ সহযোগিতা করবে।

আরও পড়ুনঃ  সরকার নয়, জনগণের পক্ষে প্রচার করুন : তথ্য উপদেষ্টা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার বৈঠকে নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যু গুরুত্ব পায়। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সংস্কার অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু তা দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে বলেছি আমরা।” জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানান, “আমরা সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্য নিয়ে কথা বলেছি।”

জাতিসংঘ মহাসচিব তার সফরে রোহিঙ্গা সংকটের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আতিথেয়তাকারী বাংলাদেশি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্যই আমি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আগামী মাস থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে গেলে মানবিক সংকট আরও তীব্র হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মতে, রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান হলো তাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। তবে, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে এটি সম্ভব নয় বলেও তিনি স্বীকার করেন।

আরও পড়ুনঃ  লিবিয়া থেকে ফিরলেন ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে, তা স্পষ্ট।” তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মিকেও আলোচনায় যুক্ত করা উচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব এসেছে। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।” তবে তিনি যোগ করেন, “বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন।”

এছাড়া, জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে মি. গুতেরেস বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ও চাপ প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে সহিংসতা বন্ধ করে একটি সংলাপ প্রক্রিয়া গড়ে তোলা যায়।”

বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরকে “ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ” হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “এই সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব উপলব্ধি করেছেন যে, রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে কতটা মরিয়া। তারা তাদের পরিচয়, অধিকার ও সম্মানজনক জীবন উপভোগ করতে চায়।”

আরও পড়ুনঃ  এআই প্রযুক্তি দাজ্জাল আবির্ভাবের প্রমাণ: মুফতি হাবিবুর রহমান মিসবাহ

সংস্কার ইস্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিবের ইতিবাচক মনোভাব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “সংস্কার বিষয়ে যে যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তার সবকিছুই করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার জন্য এবং বাংলাদেশ ও তার জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।”

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আপনাদের ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে সমর্থন জোগানো।” তিনি আশ্বাস দেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সমর্থন করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সম্পর্ক আরও গভীর ও শক্তিশালী হওয়ার আশা করা যায়। রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ও দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

সর্বশেষ সংবাদ