তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে হোসাইন মিয়া। পরে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে লেখাপড়া ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় বাসে বাসে পপকর্ন, আইসক্রিম ফেরি করে বেড়াত ১০ বছরের শিশুটি। গত ২০ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে ভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয় সে। এরপর আর হদিস নেই তার। পরে বাবা-মা তার লাশ পান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে।
ওইদিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বাবা মানিক মিয়া সন্তানের খোঁজে বের হন। টিয়ার শেলের গ্যাস আর আগুনের ধোঁয়ায় রাস্তা তখন অন্ধকার। এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান না পেয়ে দুই ঘণ্টা উল্টো পথে হেঁটে বাসায় এসে দেখেন, ছেলে এখনো ফেরেনি। এরপর দুই মেয়েকে ঘরে তালাবদ্ধ রেখে স্ত্রী মালেকাকে সঙ্গে নিয়ে আবার খুঁজতে বের হন। রাত ৯টার দিকে কেউ একজন মোবাইল ফোনে আহত হোসাইনের ছবি দেখান।
মানিক ও মালেকা বেগম সন্তানের ছবি দেখে চিনতে পারেন। এরপর তারা জানতে পারেন তাদের সন্তানকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। এরপর তারা একটি পিকআপ চালককে হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে কোনো রকম যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান। সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে একটি রিকশা করে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান। এরপর হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। কোথাও না পেয়ে কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারেন চিটাগাং রোড থেকে যারা আহত হয়ে আসছে তাদের চিকিৎসা চলছে। এরপর তারা রাত ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে ছেলে দেখার জন্য বসে ছিলেন। রাত ২টার পর একজন লোক এসে মানিক মিয়াকে মুঠোফোনে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, এটি কি আপনার সন্তান? মানিক মিয়া ছবি দেখে হ্যাঁ বললে তিনি তাকে মর্গে নিয়ে যান। মানিক মিয়া মর্গের ভেতর গিয়ে দেখেন লাশের স্তূপের ওপর তার ছেলের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। মা মালেকা বেগমের বুকফাটা চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে পুরো মেডিকেলের পরিবেশ।
গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ছোট্ট হোসাইনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বরিশল গ্রামে। তার নানার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে। হোসাইন তার মা-বাবার সঙ্গে চিটাগাং রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। মানিক-মালেকা দম্পতির মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬) নামের দুই মেয়ে আছে। নিহত হোসাইনের লাশ গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার বরিশল গ্রামে না নিতে পেরে ২২ জুলাই রাত ২টার দিকে নানার বাড়িতে দাফন করা হয়।
শনিবার বিকেলে হোসাইনের নানার বাড়ি দেবিদ্বারের বেতরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মা মালেকা বেগম ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আর্তনাদ করছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিতে এসেও চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। কেঁদে কেঁদে মালেকা বলছিলেন, “ভাত খেয়ে ঘরে থাকতে বলছিলাম। ছেলে বের হয়ে যায়। আমি বারবার ডেকে ঘরে আনার জন্য যাই, আর বলি বাবা রাস্তায় গোলাগুলি হচ্ছে, তুই বাসায় চলে আয়। ছেলে বলে, ‘মা, আমি ছোট আমারে কে গুলি করবে?’ আমি গার্মেন্টসে কাজ করতাম। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার ছেলে বলে মা তুমি চাকরি ছেড়ে দাও, আমি তোমার চিকিৎসার জন্য বাসে বাসে ফেরি করব। আমার ছেলে বাসে বাসে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট বেঁচে যা আয় করত তা পুরোটা আমার চিকিৎসার খরচ দিত। আমার সোনার মানিকের কী অপরাধ ছিল, তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? আমার ছেলেকে কেউ ফিরাই দাও। আল্লাহ, তুমি কেন আমার বুকের মানিককে কাইড়া নিলা।
হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, আমার ছেলে গত শনিবার বিকেলে মারা গেছে। এই লাশ আনতে গিয়ে কত বিপদেই না পড়ছি। এই অফিসে যাও, হেই অফিসে যাও, থানায় গিয়া জিডি করো। কত স্বাক্ষর দিছি। এরপর সোমবার ছেলের লাশ পাইছি। এই লাশ লইয়া আইতে গিয়া আরও কত বিপদ। বাড়িতে আনতে না পেরে সোমবার রাত ২টার দিকে দেবিদ্বার নানার বাড়িতে দাফন করা হয়।
দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ছোট হোসাইনের নানার বাড়িতে আমি গিয়েছি। তাদের আর্তনাদ দেখে আমি নিজেও সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে তার পরিবারকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। তাদের আরও সহযোগিতা করা হবে।