Saturday, June 28, 2025

আগে থেকেই সব ঠিকঠাক, দরপত্র যেন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র!

আরও পড়ুন

কী ব্র্যান্ডের যন্ত্র কেনা হবে, কোন প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করবে—সব আগে থেকেই ঠিকঠাক। দরপত্র শুধু আনুষ্ঠানিকতা। এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে ‘১৫ মেডিকেল কলেজ ও ৪৪ জেলা সদর হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন প্রকল্পে’। শতকোটি টাকার এই প্রকল্প এভাবেই সাজিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক এবং অতীতে দুর্নীতির দায়ে কারাভোগকারী এক ঠিকাদার। দরপত্র প্রক্রিয়াও চলমান। বাকি শুধু কার্যাদেশ দেওয়া।

জানা গেছে, সারা দেশে কিডনি ডায়ালাইসিস সুবিধার জন্য ২০১৯ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব না হলেও চলছে কেনাকাটার আয়োজন। প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিপ্রো-জেএমআইর মাধ্যমে ডায়ালাইসিস সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কেনাকাটার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে করোনা মহামারিকালে মানহীন কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহেরও অভিযোগ আছে। এই অনিয়মের দায়ে তিনি কারাভোগও করেছেন। এ ছাড়া গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতে যে হরিলুট হয়েছে, তাতেও নাম আছে নিপ্রো-জেএমআইর। এবারের দরপত্রে তাদের কাছ থেকে যে ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনা হবে, সেটা পরিচালনা জটিল ও দুর্ভেদ্য বলছেন সংশ্লিষ্টরা, যা পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনবল নেই।

জানা যায়, ১৫ মেডিকেল কলেজ ও ৪৪ জেলা সদর হাসপাতালে ডায়ালাইসিস যন্ত্র স্থাপন প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ডায়ালাইসিস যন্ত্র ও সমসংখ্যক অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনাকাটার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের জিডিই-১ লটের আওতায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর ৮ মেডিকেল কলেজ ও ১৬ জেলার জন্য ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে সরকারের ব্যয় প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। দরপত্রে এমনভাবে নির্দেশাবলি (স্পেসিফিকেশন) তৈরি করা হয়েছে, নিপ্রো-জেএমআই ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে সরবরাহ করতে না পারে।

দরপত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিঙ্গেল লটের প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিয়েছে জার্মানির ফ্রেশেনিয়াস ব্র্যান্ডের আমদানিকারক ট্রেডভিশন লিমিটেড, যুক্তরাষ্ট্রের বেক্সটার ব্র্যান্ডের পরিবেশক জনতা ট্রেডার্স, জাপানের টরে ব্র্যান্ডের পরিবেশক মুডাস ইন্টারন্যাশনাল, জার্মানির বি-ব্রাউন ব্র্যান্ডের পরিবেশক এমআরজেড করপোরেশন, জাপানি নিকোশি ব্র্যান্ডের পরিবেশক ব্যাংলাদেশ হেলথ প্রডাক্ট এবং জাপানের নিপ্রো ব্র্যান্ডের জেএমআই-নিপ্রো।

আরও পড়ুনঃ  যুবদলের নামে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা ধরা

প্রকল্পের জিডি-২ লটের সঙ্গে জিডিই-১ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জিডি-২ লটে ডায়ালাইসিস যন্ত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে শর্ত হিসেবে ১২ ইঞ্চি বা তার চেয়ে বড় টিউনাবল টাচ স্ক্রিনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে জিডি-১ লটে বলা হয়েছে, অবশ্যই ১০ ইঞ্চি বা তার চেয়ে বড় টিউনাবল টাচ স্ক্রিন হতে হবে। প্রকল্পের ২০২২ সালের কেনাকাটায় ডায়ালাইসিস মেশিনের ডায়ালাইসেট ফ্লো রেট ৩০০-৮০০ মিলি/মিনিটের মধ্যে হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু এই লটে ফ্লো রেট চাওয়া হয়েছে ২০০-৮০০ মিলি/মিনিট। জিডিই-১ প্রকল্পের কেনাকাটায় হেমোডায়ালাইসিস ফাংশন (এইচডিএফ) চাওয়া হয়েছে। এর আগে ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটার দরপত্রে এইচডিএফ চাওয়া হয়নি। সরবরাহকারীকে পাঁচ বছরের মধ্যে একটি দরপত্রে শুধু ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটায় ৭০ কোটি কিংবা তার বেশি টাকার যন্ত্র সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পে ২০২২ সালের জিডি-২ লটের কেনাকাটায় পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথক দুটি দরপত্রে ২২ কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।

একাধিক সরবরাহকারী বলেন, নিপ্রো এনসিইউ-১৮ যন্ত্র ঘিরে এই স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিপ্রো অভিজ্ঞতাকে ঘিরে দরপত্রের শর্ত ঠিক করা হয়। নিপ্রো-জেএমআই ছাড়া এই শর্ত দেশের কোনো সরবরাহকারীর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। দরপত্রের অনিয়মের অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ দিয়েছে জার্মানির ফ্রেশেনিয়াস ব্র্যান্ডের আমদানিকারক ট্রেডভিশন লিমিটেড।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক কিডনি বিশেষজ্ঞ কালবেলাকে বলেন, দেশের একমাত্র বিশেষায়িত কিডনি রোগ চিকিৎসার প্রতিষ্ঠান জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালেও (নিকডু) হেমোডায়ালাইসিস ফাংশন (এইচডিএফ) নেই। জেলা সদর হাসপাতালে এই যন্ত্র পরিচালনা করা অসম্ভব। আমাদের আগে ডায়ালাইসিস সেবা নিশ্চিত করতে হবে। নিকডু বা দেশের পুরোনো আট মেডিকেল কলেজ ছাড়া অন্যদের এইচডিএফ পরিচালনা করার সক্ষমতা নেই। এখন জেলা সদর হাসপাতালের জন্য এইচডিএফ-সংবলিত ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনা হবে সরকারি অর্থের অপচয়।

আরও পড়ুনঃ  নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ বাতিলের পরামর্শ

তিনি বলেন, এই প্রযুক্তি পরিচালনা করা খুবই ব্যয়বহুল, তারপর অভিজ্ঞ জনবল নেই। এইচডিএফের ব্লাড লাইনের দাম আছে প্রায় এক হাজার টাকা। প্রচলিত ডায়ালাইসিস মেশিনে ব্লাড লাইনের দাম পড়ে সর্বোচ্চ দেড়শ থেকে দুইশ টাকা। ফিল্টারের দামও অনেক। এইচডিএফের জন্য আলাদা ফিল্টার আছে, সেগুলোর দাম অনেক। সেটাও কয়েক হাজার টাকা হবে। জেলা সদর হাসপাতাল এমন প্রযুক্তি পরিচালনায় উপযুক্ত নয়।

ওই চিকিৎসক আরও বলেন, দরপত্রের অসংগতিগুলো প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটায় আগ্রহী। ওই কোম্পানি তাকে কোনোভাবে প্রলুব্ধ করেছে। এভাবেই ওই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পিডিকে দিয়ে তাদের ইচ্ছামতো স্পেসিফিকেশন তৈরি করিয়েছে। যেখানে জাপানি নিপ্রোর ডায়ালাইসিস মেশিন সরবরাহ করা হব। কিন্তু দেশের ডায়ালাইসিস সেবায় নিয়োজিতদের এই যন্ত্র সম্পর্কে ধারণা খুবই নেতিবাচক। অনেক জায়গায় তাদের দেওয়া যন্ত্র দুই থেকে তিন মাস ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। ডায়ালাইসিস মেশিনের বোর্ড নষ্ট হয়ে গেছে। ওদের কাছে বোর্ডের সাপোর্টও নেই। কভিডকালে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) দরপত্রে নিপ্রোর ডায়ালাইসিস মেশিন কেনাকাটা করা হয়েছিল।

নোয়াখালী জেলা সদর হাসপাতালে এই প্রতিষ্ঠান সিএমএসডির মাধ্যমে কেনা নিপ্রোর ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস মেশিন সরবরাহ করেছিল। তার মধ্যে চারটি মেশিন অচল হয়ে পড়ে আছে। নিপ্রো-এনসিইউ ১৮ ডায়ালাইসিস মেশিন অতিরিক্ত সেন্সরড। এইচডিএফ তো পরের কথা, সাধারণ ডায়ালাইসিসও করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সেন্সর মেশিন বারবার বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি কোম্পানি ঘিরেই দরপত্রের পুরো আয়োজন সাজানো হয়েছে। নিপ্রোর যন্ত্র কিনলে দেশের সব ডায়ালাইসিস সেন্টার অচল হয়ে যাবে।

তবে প্রকল্প পরিচালক কালবেলাকে বলেছেন, ‘কোনো কোম্পানিকে কেন্দ্র করে স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়নি। আমাদের কোনো পক্ষপাতিত্ব (বায়াসনেস) নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো স্বার্থও (ইন্টারেস্ট) নেই। আমি যন্ত্রগুলো একটু হালনাগাদ (আপডেট) কিনতে চাই। পরবর্তী প্রজন্ম (নেক্সট জেনারেশন) যাতে এই মেশিন ব্যবহার করতে পারে, সেই চিন্তা মাথায় রেখেই তো কেনাকাটা করতে হবে, তাই না?’

আরও পড়ুনঃ  জামাই-শ্বশুর মিলে সোনালী লাইফের ৩৫৩ কোটি লুট ৪৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে মেশিন দিচ্ছি, এই মেশিনে ডায়ালাইসিস করা যাবে, আবার চাইলে এইচডিএফও করা যাবে। এইচডিএফে ২০ পার্সেন্ট মর্টালিটি কম হবে। প্রচলিত মেশিনে প্রতিদিন ২০০ টাকার নরমাল স্যালাইন লাগে, এইচডিএফে এটা লাগবে না। একেকজন রোগীর পেছনে দৈনিক ২০০ টাকা বেঁচে যাবে। আমাদের তো চিকিৎসায় গুণগত মান বাড়াতে (কোয়ালিটি ইমপ্রুভ) হবে। জনবলের পদ তৈরি করে ফেলেছি। জুনিয়র কনসালট্যান্ট, সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং নার্সের পদ তৈরি করেছি। জনপ্রশাসন থেকে পদ অনুমোদন হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি আসার আগেই জনবল প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হবে। এই কেনাকাটা নানান চেষ্টায় টেন্ডারের পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এখন যদি দেরি হয়, তাহলে হয়তো প্রজেক্টটা আর হবে না।’

অবশ্য এই ডায়ালাইসিস যন্ত্র প্রসঙ্গে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ কালবেলাকে বলেছেন, ‘সরকারি হাসপাতালে সহজে ব্যবহারযোগ্য (ইউজার ফ্রেন্ডলি) বেসিক মডেলের ডায়ালাইসিস মেশিন দরকার। এসব মেশিন সব জায়গায় অদক্ষ জনবল দিয়েও চালানো যায়। জার্মানির ফ্রেশেনিয়াস ব্র্যান্ড, জার্মানির বি-ব্রাউন ব্র্যান্ড এবং জাপানের নিপ্রা ব্র্যান্ডের বেসিক মডেলের মেশিনগুলো অপারেট করতে বেশি দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হয় না। মেশিন নিজেই সব কাজ করে। আমাদের যেহেতু জনবল কম, তাই এসব ব্র্যান্ডের প্রচলিত মেশিনই বেশি ব্যবহার (ইউজ) করা হয়।’

তিনি বলন, ‘দামি মেশিনের দরকার নেই। দরকার এখন পরিমাণ (কোয়ানটিটি)। সরকারি হাসপাতালে দরকার যেসব মেশিন সহজে নষ্ট হয় না। যেসব মেশিনের দামও কম, আবার সার্ভিসও বেশি দিতে পারে এগুলোই দরকার। এইচডিএফ চালানো এখানে অসম্ভব (ইমপসিবল)। লোকজন বুঝবেই না এইচডিএফ কী জিনিস। টারশিয়ারি হাসপাতাল যেখানে নেফ্রোলজিস্ট সবসময় থাকেন এবং যেখানে কমপ্লিকেটেড কেসগুলো আসে, সেখানে ব্যবহার করা যেতে পারে এইচডিএফ। কারণ, জটিল রোগীর জন্য হলো এইচডিএফ। তা না হলে এগুলোর দরকার নেই। এইচডিএফ টারশিয়ারি হাসপাতালের জন্য দু-একটা করে মেশিন কেনা যেতে পারে।’

সর্বশেষ সংবাদ