প্রায় এক বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় ব্যাপক বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সেখানে এখনো মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে দেশটি। ইসরায়েলের এ বর্বরতার বিরুদ্ধে লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ রুখে দাঁড়ানোয় এবার লেবাননে বিমান হামলার পাশাপাশি স্থল অভিযান শুরু করেছে তেল আবিব। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরায়েলে মঙ্গলবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর প্রশ্ন উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যে কি বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? কারণ ইরানের হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইরান মঙ্গলবার বড় ভুল করে বসেছে। যথাসময়ে ও যথাস্থানে এর জবাব পাবে তারা। অর্থাৎ ইরানে যে বড় ধরনের ইসরায়েলি হামলা আসছে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা একরকম নিশ্চিত। আর সেরকমটা ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরায়েল-হামাসের চলমান সংঘাতের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধ শুরু হলে তার ভার বহন করতে কি বিশ্ব প্রস্তুত?
দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারির পর বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক সে সময় আচমকা শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আড়াই বছর ধরে চলতে থাকা এ যুদ্ধ সারা বিশ্বে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের দুটি বৃহৎ খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে শুরু হওয়া এ যুদ্ধের কারণে টালমাটাল হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটাই দায়। ইউরোপের অনেক দেশেও মূল্যস্ফীতিতে জেরবার সাধারণ মানুষকে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজপথে নামতে দেখা যায়। এরকম এক অবস্থার মধ্যে ইসরায়েলে হামাসের হামলা ও একে ঘিরে গাজায় প্রায় এক বছর ধরে যে ইসরায়েলি বর্বরতা চলছে তার ফলে অস্থির হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ব। বিশ্ব নেতৃত্ব ও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসভা এ দুটো যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। গাজাকে ঘিরে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানপন্থি বিভিন্ন ফ্রন্টের যুদ্ধ চলছে। হামাস ছাড়াও লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতিসহ বিভিন্ন ইসলামিক প্রতিরোধ যোদ্ধার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে ইসরায়েলকে। ইসরায়েল গাজা থেকে সম্পূর্ণ সরে না গেলে দেশটিতে হামলা করা থামাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে এসব গোষ্ঠী। এরই মধ্যে ইরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হত্যা করার পর যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। এরপর লেবাননে পেজার হামলা ও তারপর হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার পর মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় ধরনের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। নাসরুল্লাহকে হত্যার পর ইরান যে ইসরায়েলের নাগালের মধ্যে রয়েছে তা সরাসরি জানিয়ে দেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তাছাড়া হানিয়া ও নাসরুল্লাহর মতো কান্ডারিকে হারিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে হামাস ও হিজবুল্লাহ। এর সঙ্গে পেজার হামলার মতো অভিনব ডিভাইস হামলার ঘটনাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুনে আরো ঘি ঢালছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার ইসরায়েলে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এখন যে কোনো সময় ইসরায়েল থেকে ইরানে বড় ধরনের পাল্টা হামলা হতে পারে। আর সেরকমটা হলে এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে তো ছড়িয়ে পড়বেই, সেইসঙ্গে ইউরোপসহ সারা বিশ্বে এর মারাত্মক প্রভাব দেখা দেবে। ইরানের মিত্র হিসেবে না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই রাশিয়া ও চীন যুদ্ধের পেছনের কারিগরের ভূমিকায় ঢুকে পড়বে নিশ্চিতভাবে।
মঙ্গলবার ইসরায়েলে ইরানের হামলার পরপরই বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় তেলের দাম। ব্রেন্ট ক্রুড তেলকে আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি বলে বিবেচনা করা হয়। এ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১ শতাংশের বেশি বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৪ দশমিক ৪০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্যবিষয়ক প্রশাসনের (ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) তথ্য অনুসারে, ইরান বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। ওপেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তেল উৎপাদনে দেশটির অবস্থান তৃতীয়। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা বেড়ে গেলে হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচলের ওপর প্রভাব পড়বে। ওমান ও ইরানের মধ্যে জাহাজ চলাচলের যে পথটি আছে, সেটি বিশ্বের তেল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বিশ্বে তেল সরবরাহের ২০ শতাংশই এ পথে হয়। ওপেকভুক্ত দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাকও তাদের তেল রপ্তানির একটা বড় ভাগই হরমুজ প্রণালি দিয়ে করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এ হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের একটা আঘাত দেখা দেবে। এ ছাড়া, ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনার পাশাপাশি দেশটির তেল উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতেও হামলার কথা ভাবছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার সিনেটর সেন লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, ‘আমি ইরানের তেল উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে হামলা করার পক্ষপাতি। ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে এর কোনো বিকল্প নেই। দেশটির ওপর শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে চলবে না, এর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল শিল্পেও আঘাত হানতে হবে।’ তার এ মন্তব্য আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছে। গাজাসহ বিশ্বের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউরোপের অনেক মিত্র দেশও ইসরায়েলের পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে ইরানের মতো অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশে হামলা হলে মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে, বিশ্ব তা সামাল দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ ইয়ারাপেত্রিতিস কোনো রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন, বিশ্ব হয়তো লেবাননে সামাল দিতে পারবে না। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর হামলা হলে বসে থাকবে না ইরান। আর ইরান সক্রিয় হলে মারাত্মক বেপরোয়া হয়ে উঠবে ইসরায়েল, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে তা সামাল দিতে পারবে না বিশ্ব সম্প্রদায়। তার মতে এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন ও গাজা ইস্যুও বিশ্ব সামাল দিতে পারেনি। ইয়ারাপ্রেত্রিতিস বলেন, ‘লেবাননের সংঘাত বৃদ্ধি একটি ‘মাইনফিল্ড’, যেটি বিশ্ব সম্প্রদায় হয়তো সামাল দিতে পারবে না। আমরা বিস্তৃতি ও যুদ্ধের আরও ছড়িয়ে পড়া রোধ করিনি, পরিস্থিতির যত অবনতি হবে, সেটি সমাধান করা তত জটিল হবে। লেবানন সহজেই ভয়ংকর শত্রুতার একটা অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে আর তা এমন কিছু হতে পারে, যা হয়তো আমরা সামাল দিতে পারব না। এটি পরিষ্কারভাবে একটি মাইনফিল্ড।’