Saturday, January 11, 2025

রাউজানে এমপির ত্রাসে বিভীষিকার দুই যুগ

আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলা। অনেকের কাছেই এটি ভয়ংকর এক জনপদের নাম। দুই যুগ ধরে সেখানে ঘটেছে একের পর এক গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর অপরাধ। হাজার হাজার মানুষকে নির্মম অত্যাচার, নিপীড়ন, গুম-খুন, হামলা-মামলা, জমি দখল, ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, যৌন নিপীড়নসহ এমন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই, যা হয়নি এই উপজেলায়। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মী, মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ভক্ত থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও নির্যাতিত হয়েছেন। হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ভাঙচুর করা হয়েছে বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দির, মাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবুও প্রতিবাদ দূরের কথা, মুখ খুলতেও সাহস পায়নি কেউ। কারণ, সব অপরাধের মূল হোতা ছিলেন ওই এলাকার সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। দীর্ঘ ২৪ বছর রাউজানে ত্রাসের রাজত্ব চলেছে তার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছে রাউজানের নির্যাতিত মানুষ।

গুম, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগে এখন পর্যন্ত রাউজান ও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম-৬ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য ভারতে পালাতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার আখাউড়া সীমান্তে বিজিবির কাছে ধরা পড়েছেন।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ফজলে করিম চৌধুরী ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকার তালিকায় থাকা একেএম ফজলুল কবির চৌধুরীর সন্তান। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে আওয়ামী লীগের বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কর্মী ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে এনডিপির শীর্ষ নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন ফজলে করিম। সেই সূত্র ধরে এনডিপির আলোচিত ক্যাডার এসকান্দরসহ ৪০ থেকে ৪৫ জনকে নিয়ে এনডিপি থেকে পদত্যাগ করেন। পরে নিকটাত্মীয় সাবের হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে রাউজানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এমনকি ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলটির মনোনয়নও বাগিয়ে নেন। তবে সেবার বিপুল ভোটে হেরে যান। এরপর ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৭ হাজার ৩২৯ ভোটে হারিয়ে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের এমপি নির্বাচিত হন ফজলে করিম চৌধুরী। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  প্রশংসায় ভাসছেন ড. ইউনূস

সরেজমিন রাউজান ঘুরে জানা যায়, ফজলে করিম চৌধুরী ওরফে জুইন্যা এতটাই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিলেন যে তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল রাউজানবাসী। তিনি উপজেলাজুড়ে কায়েম করেছিলেন একনায়কতন্ত্র। শুধু বিএনপি, জামায়াত কিংবা মুনিরিয়া যুব তাবলিগ নয়, ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে থাকলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়তে হতো। তার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না প্রশাসনেরও। উন্নয়ন কাজের টেন্ডার থেকে শুরু করে সরকারি নিয়োগসহ সবকিছুই হতো তার নির্দেশে। তাকে ম্যানেজ করা ছাড়া জনপ্রতিনিধি হওয়ার উপায় ছিল না কারও। নির্বাচিত হয়েও এমপির রোষানলে পড়ে পৌরসভার অফিসে যেতে পারেননি সাবেক মেয়র দেবাশীষ পালিত। দিনেদুপুরে হত্যা, অত্যাচার, গুম, হামলা, মামলা, ভাঙচুর ছিল তার নিত্যদিনের কাজ।

আরও পড়ুনঃ  বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে আ.লীগের আহ্বান

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য গ্রেপ্তারের আগে বেশ কয়েক দিন এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর রাউজানের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে অনেকবার কল করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

সম্পত্তি এমপির নামে লিখে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, যে বাড়িতে ঘরবাড়ি ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত মন্দির এবং পূর্বপুরুষদের শ্মশান রয়েছে। রাউজানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান হলেও রাউজান সদরে অবস্থিত সরকারি ডাকবাংলোটি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী এমপির পিতা মরহুম ফজলুর কবির চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।

ফজলে করিমের বিরুদ্ধে যত মামলা:

গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গা ঢাকা দিয়েছিলেন সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম। গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) তিনি ভারতে পালাতে গিয়ে আখাউড়া সীমান্তে ধরা পড়েন।

সরকার পতনের পর ফজলে করিমের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেন ভুক্তভোগী মানুষ। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রাউজান ও চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে।

আদালত ও থানা সূত্র থেকে জানা যায়, গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে গুম করে হত্যার চেষ্টা, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মামলা করেন পশ্চিম গুজারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজউদ্দিন দৌলা। সেই মামলা এবিএম ফজলে করিমসহ ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। ২৩ আগস্ট রাউজান থানায় বাদী হয়ে হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাট ও কোরআন পুড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা করেন মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ১০৩ নম্বর দলইনগর-নোয়াজিষপুর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন। ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৩ জনকে আসামি করে সেই মামলা করা হয়। ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন ইসতিয়াক হোসেন ওরফে বজল। সেখানেও ফজলে করিমসহ ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। একই দিন রাউজান থানায় ভাঙচুর, লুটপাট ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা করেন মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ২০৪ নম্বর ফকিরটিলা শাখার সহসভাপতি মো. জোহেল উদ্দীন। ২৭ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। ২৮ আগস্ট পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন লালখানা বাজার এলাকার মো. দুলাল। ৩০ আগস্ট চান্দগাঁও থানায় হত্যা মামলা করেন বহদ্দারহাট এলাকার মো. শরীফ। মামলায় ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৪ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর স্ত্রী সুমি আক্তার।

আরও পড়ুনঃ  ববিতে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, আহত ১৫

সর্বশেষ সংবাদ