রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠনের অভিপ্রায়ে ৫৫ সদস্যের জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে। নবগঠিত এই প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে আছেন সামান্তা শারমিন। তিনি কমিটির সার্বিক বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাবি প্রতিনিধি মো. জাফর আলী জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের চিন্তা কীভাবে এলো, এর উদ্দেশ্য কী এবং কীভাবে এটি কাজ করবে?
সামান্তা শারমিন: এই গণঅভ্যুত্থানে আমরা দুটি অংশ দেখতে পেয়েছি। যার মধ্যকার একটি হলো ছাত্র ও অন্যটি জনতা। ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং পরবর্তী সময়ে জনগণের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। ছাত্ররা এখনো বিভিন্ন ইস্যুতে এক হয়ে কাজ
করছেন। কিন্তু এই পর্যায়ে জনতার উপস্থিতি একটু হ্রাস পেয়েছে, তারা নিজেদের কাজে ফিরে গেছে। বিশেষ করে যুবকদের বড় একটি অংশ। এজন্য আমরা চিন্তা করছি, জনতার মধ্যকার যুবকদের অংশকে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে দেশকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করার। আমাদের কমিটির কাজ হবে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা; রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও জবাবদিহির পরিসর তৈরি করা; বিভিন্ন সামাজিক, আলোচনা, মতবিনিময় ও গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সর্বস্তরের জনতাকে সংহত করার লক্ষ্যে কাজ করা; ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা; জনস্বার্থের পক্ষে নীতিনির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক সংলাপের আয়োজন করা; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিনির্ধারণী প্রস্তাবনা তৈরি ও সেটা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণআলোচনার আয়োজন করা।
এই কমিটিতে কোন বিবেচনায় লোকজনকে যুক্ত করা হয়েছে বা ভবিষ্যতে কীভাবে যুক্ত করা হবে অথবা এর বিস্তৃতি কীভাবে ঘটবে?
সামান্তা শারমিন: নাগরিক কমিটিতে যারা আছেন, তাদের কারোরই কোনো দলীয় সম্পৃক্ততা নেই। কারও কারও অতীতে থাকলেও থাকতে পারে, এই মুহূর্তে নেই। বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার জন্য গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, ভাবাদর্শ, মতাদর্শ নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করার প্রচেষ্টা করব—এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। কিন্তু সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে হটানো সম্ভব হলেও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা রয়েই গেছে এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তও হয়নি। সেই কারণে কমিটিতে যারা বর্তমানে আছেন এবং ভবিষ্যতে যারা যুক্ত হবেন, তারা কেউ দলীয় ব্যানারে বা দলীয় পদ থাকা অবস্থায় আসতে পারবেন না। তাদের নানারকম সামাজিক উদ্যোগ থাকতে পারে, সে ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যার অবদান দেশ পুনর্গঠনে কাজ করবে, সেই অনুযায়ী আমরা তাকে যুক্ত করার চেষ্টা করব। গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে যদি নিজের মতাদর্শকেও সেক্রিফাইস করতে হয়, তাহলে আমরা সেটাই করব দেশের কথা ভেবে। এই চিন্তাভাবনার জায়গা থেকেই কমিটি গঠিত হয়েছে এবং জেলা, উপজেলা ও মহানগর কমিটিতেও এটা মাথায় রাখা হবে।
সরকার, রাজনৈতিক দল, জনগণ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটির কার সঙ্গে কী সম্পর্ক থাকবে?
সামান্তা শারমিন: সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে জবাবদিহি এবং সহযোগিতাভিত্তিক। আমরা মনে করি, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনতার সরকার। আমরা তাদের এম্পাওয়ার্ড করেছি এজন্যই তারা ক্ষমতায় আছেন। তাদের মনে রাখতে হবে, জনগণ চাইলে তারা থাকবে বা চলে যাবে। এজন্য বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং দেশকে গুছিয়ে দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য আমরা নানা ধরনের পথ খোলা রেখেছি। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা হবে বোঝাপড়া, পরামর্শ এবং আলাপ-আলোচনাভিত্তিক। আসল কর্তব্য ও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা, রাজনীতি করার জন্য তাদের কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তাদের প্রস্তাবনা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ নিয়ে কাজ করা হবে। আমরা চাই, দেশের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলের কমন কিছু চিন্তাভাবনা বা ক্ষেত্র তৈরি হোক। আমরা বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে বসব এবং করণীয় নির্ধারণ করব। আর জনগণের জন্যই আমাদের সব কার্যক্রম, জনগণের সঙ্গে এটাই আমাদের সম্পর্ক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক আছে। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমরা কোনো লেজুড়বৃত্তিক সম্পর্কে নেই এবং কোনো মাদার পার্টি হিসেবে কাজ করব না। তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা হবে বোঝাপড়াভিত্তিক।
কালবেলা: নাগরিক কমিটির কাজ নিয়ে আপনারা কতটুকু আশাবাদী বা কতটুকু সফল হতে পারবেন বলে মনে হয়?
সামান্তা শারমিন: ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানও কিন্তু আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দিতে পারেনি এবং তা মূলত ব্যর্থ হয়েছে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে ৯০-এর অভ্যুত্থানের মতো ব্যর্থ হতে দিতে চাই না। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এবার অন্তত দেশটাকে ঠিক করতেই হবে। তা না হলে এই বাংলাদেশটা আবার কোনো এক দল মানুষের হাতে চলে যাবে। যাদের চিন্তাভাবনার বিষয়টা বাংলাদেশকে নিয়ে নয়; বরং ব্যক্তি এবং খুব বেশি হলে তাদের রাজনৈতিক দল নিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভালো হোক—এটা তাদের মেইন কনসার্ন নয়। এজন্য আমরা মনে করি, বাংলাদেশের মানুষ একত্রিত হয়ে পুনর্গঠনের কাজে যদি লেগে যায়, তাহলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।