Wednesday, June 25, 2025

বিনা টেন্ডারে ওরাকলকে ২০৭ কোটির কাজ দেন পলক

আরও পড়ুন

কোনোরকম প্রতিযোগিতা ছাড়াই জাতীয় ডাটা সেন্টারের জন্য ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ওরাকলকে ক্লাউড সেবার দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে দেওয়া এই কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সেই সময়ের দর অনুযায়ী ২০৭ কোটি টাকার বিনিময়ে তিন বছর ক্লাউড সেবা দেওয়ার কথা ওরাকলের। তবে রহস্যজনক কারণে চুক্তি স্বাক্ষরের আড়াই বছর পর ক্লাউড সেবা চালু করে ওরাকল।

জানা গেছে, বাছবিচার ছাড়াই ভিনদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেশের তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের। তার চাপেই দরপত্র আহ্বান না করে ওরাকলকে সরাসরি কাজ দেওয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন পলক। তারচেয়ে প্রভাবশালী একটি পক্ষও সেই টাকার ভাগ পেয়েছিল। পুরো প্রক্রিয়ার পরিকল্পনাকারী ছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) তৎকালীন পরিচালক তারিক এম বরকতউল্লাহ। পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইকরামুল হক এই লেনদেনের সহযোগী ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের দিকে সরকারি সংস্থাগুলোর উপাত্ত সংরক্ষণে সরকারের একটি কেন্দ্রীয় ক্লাউড সেবা ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর আগে সংস্থাগুলো নিজেদের মতো অর্থ খরচ করে ক্লাউড সেবা নিত। সেই সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ কেন্দ্রীয়ভাবে ক্লাউড ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেয়। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ক্লাউড ব্যবস্থা তৈরি করে সরকারি সংস্থাগুলোকে ভাড়ায় দিয়ে অর্থ উপার্জন এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়। এমন একটি ক্লাউড সেবার প্রস্তাব সে সময় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীন জাতীয় ডাটা সেন্টারকে (এনডিসি) দেয় ওরাকল। তবে বিসিসির তৎকালীন পরিচালক তারিক এম বরকতউল্লাহ সেই প্রস্তাব ঘুরিয়ে দেন বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) দিকে।

আরও পড়ুনঃ  হিট স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি শাহরুখ খান

সূত্র বলছে, পলককে প্রভাবিত করে ডাটা সেন্টারে ওরাকলের ক্লাউড ব্যবস্থা স্থাপনের মূল ‘মাস্টারমাইন্ড’ এই তারিক বরকতউল্লাহ। প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সদস্যরা এই ক্লাউড সেবার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। শুধু তারিক বরকতউল্লাহ ওই কমিটির প্রতিবেদনে এককভাবে ভেটো দেন।

পরবর্তী সময়ে পলকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ওরাকলের সঙ্গে বিডিসিসিএল ‘ডেডিকেটেড রিজিওনাল ক্লাউড’ স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই ক্লাউড থেকে তিন বছরের সেবা নিতে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বছরে যথাক্রমে ৩০, ৬০ এবং ৯০ লাখ ডলার পরিশোধ করার কথা বিডিসিসিএলের। বিদ্যুৎ খাতের কুইক রেন্টালের সঙ্গে তুলনা করলে ওরাকলের সঙ্গে বিডিসিসিএলের এই অসম চুক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

সেবার জন্য ওরাকলকে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এই লেনদেনের ৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা ৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকার (ডলারের দাম ১১৫ টাকা হিসেবে) একটি অর্ডার ডকুমেন্ট রয়েছে কালবেলার কাছে।

সেখানে দেখা যায়, ভিন্ন কোনো টেন্ডার বা চুক্তি না করে, পূর্বের চুক্তি মূলেই ওরাকল সিঙ্গাপুর থেকে সেবা নেওয়ার নামে ওই অর্থ পরিশোধ করা হয়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, পলক যখন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল ডাটা সিঙ্গাপুরে রাখছিলেন, তখনই ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২’ নামে একটি আইনের খসড়াও করছিল তার অধীন আইসিটি বিভাগ। সেই খসড়ার অন্যতম বিষয় ছিল বাংলাদেশের ডিজিটাল উপাত্ত বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই সংরক্ষণ করা। অর্থাৎ একদিকে তথ্য স্থানীয়করণের আইন তৈরি আর অন্যদিকে নিজেই তথ্য দেশের বাইরে পাঠাচ্ছিলেন পলক।

আরও পড়ুনঃ  ইতালি ভিসাপ্রত্যাশীদের জন্য সুখবর

এসব কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র কালবেলাকে জানায়, ওরাকলের বাংলাদেশে ক্লাউড স্থাপন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী। সিঙ্গাপুর থেকে উপাত্ত দেশে ফিরিয়ে আনলেই উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাস করতেন তিনি। তবে ওরাকলের যন্ত্রাংশ আমদানিবিষয়ক জটিলতায় বিষয়টি দীর্ঘায়িত হয়।

এই যন্ত্র আমদানিতেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন পলক। ওরাকলের ক্লাউড বসবে গাজীপুরের হাইটেক পার্কে অবস্থিত বিডিসিসিএল ডাটা সেন্টারে। নিয়ম অনুযায়ী, হাইটেক পার্কের বিনিয়োগকারীরা বিনাশুল্কে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারে। পলকের পরামর্শে ওরাকল কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে বিনাশুল্কে ক্লাউড যন্ত্রাংশ খালাসের চেষ্টা করে। তবে বিষয়টি ধরা পড়ায় কাস্টমস যন্ত্রাংশগুলোর খালাস আটকে দেয়। এ ঘটনার কারণেই রাজস্ব বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় পলকের।

পরে মোটা অঙ্কের রাজস্ব দিয়েই যন্ত্রাংশ খালাস করে ওরাকল। এজন্য পলক নিজের কমিশনে কিছুটা ছাড় দিয়েছিলেন বলেও বিডিসিসিএলে প্রচলিত রয়েছে। আর পলকের পক্ষে এসব লেনদেন দেখভাল করতেন তার এক সময়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইকরামুল হক। বিশ্বস্ততার পুরস্কারস্বরূপ, ১৬ হাজার টাকার বেতন স্কেলের ইকরামকে সরাসরি ৫০ হাজার টাকা বেতন স্কেলে বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) পদে বসান পলক। উদ্দেশ্য ছিল আস্থাভাজন ইকরামের মাধ্যমে বিডিসিসিএল আর ওরাকলের মধ্যকার লেনদেন থেকে শেয়ার বুঝে নিতে নিজের লোককে বসানো।

আরও পড়ুনঃ  সন্ত্রাসীদের হামলায় যুগান্তর সাংবাদিক আহত

ডাটা সেন্টার এবং ক্লাউড প্রযুক্তিতে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন বিশেষজ্ঞ কালবেলাকে বলেন, যে অর্থ ওরাকলে খরচ করা হয়েছে, সেই অর্থে নিজেদের ক্লাউড তৈরি করা যেত। স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ লোকবল না থাকলে বিদেশ থেকে আনা যেত অথবা এখানকার মানবসম্পদকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো যেত। এতে একটু সময় লাগলেও, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের লাভ হতো। ওরাকলের এই ক্লাউড প্রযুক্তি অনেক সরকারি দপ্তর ব্যবহারও করছে না। কারণ তাদের কাছে বিষয়টি জটিল মনে হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করার; কিন্তু সেখানেও সরকারি কর্মকর্তাদের আগ্রহ কম। ফলে এই ক্লাউডের সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহৃতই থাকে কি না এবং আয় করে ওরাকলের বিল পরিশোধ করা যায় কি না—সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এ বিষয়ে ওরাকলের বক্তব্য জানতে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রুবাবা দৌলার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনসংযোগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এ সময় তিনি জনসংযোগ শাখার সংশ্লিষ্টদের মোবাইল নম্বর ও ইমেইল ঠিকানা পাঠাবেন বললেও পরে আর সাড়া দেননি।

সর্বশেষ সংবাদ