Tuesday, March 25, 2025

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বাংলাদেশের নজর যেসব বিষয়ে

আরও পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলতি সপ্তাহে চীন সফরে যাচ্ছেন। তার সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে আরও গভীর অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিকে নজর দিচ্ছে। এই সফর দুদেশের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আঞ্চলিক পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে এই সফর ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার, চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পানি ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী।

সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য বেইজিংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে। আমরা চীনের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগ চাই এবং সেখানে আমাদের পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি।’

প্রধান উপদেষ্টার সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতা গুরুত্ব পাচ্ছে

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। আমরা আশা করছি, চীনা কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা এখানে স্থানান্তর করবে এবং বাংলাদেশের অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশের সুবিধা নেবে।

তিনি উল্লেখ করেন বাংলাদেশ এখনও বেইজিংয়ের বাজার সুবিধাগুলো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি, কারণ রপ্তানির জন্য পণ্যের পরিধি সীমিত। চীনের বিশাল ভোক্তা বাজারে প্রবেশের জন্য রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আরও পড়ুনঃ  আসামে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি, মৃত বেড়ে ১৫

স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা

স্বাস্থ্যসেবা খাতেও সহযোগিতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়, বিশেষ করে বাংলাদেশি রোগীরা ভারতের ভিসা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে চিকিৎসা নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম দল ইতোমধ্যে চীনে চিকিৎসার জন্য গেছে। আমরা চাই ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনে বিনিয়োগ করুক চীন।

বাংলাদেশ চীনের কাছে অনুরোধ করেছে কুনমিংয়ে চারটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করতে, যেখানে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকবে। এই প্রথম দলটির অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের চিকিৎসা সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পানি ব্যবস্থাপনা ও তিস্তা ইস্যু

পানি ব্যবস্থাপনাও আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়, যেখানে বাংলাদেশ নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে তিস্তা নদী ইস্যুতে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এগিয়ে নিতে চাই।’

বিশেষজ্ঞ মতামত

প্রধান উপদেষ্টার এ সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বৈশ্বিক জোটের রদবদলের মধ্যে বাংলাদেশ যখন তার পথ নির্ধারণ করতে চাচ্ছে, তখন ড. ইউনূস চীন সফরে যাচ্ছেন। তার এই সফর কৌশলগত বিবেচনার সঙ্গে অর্থনৈতিক আবশ্যিকতার ভারসাম্য বজায় রেখে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার স্পষ্ট অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সফর প্রতীকী তাৎপর্য বহন করছে এবং ভবিষ্যতে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করবে।

আরও পড়ুনঃ  ৬ দিনের রিমান্ডে আমু, মেরে বের করে দেওয়া হল আইনজীবীকে

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের প্রতীকী তাৎপর্যের ওপর জোর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, এই সফর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করবে। সফরে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে, যা বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির পথ প্রশস্ত করবে।

চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এ সফর দু-দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। তবে তিস্তার মতো বড় প্রকল্পগুলোর জন্য সম্ভবত নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, চীনের কাছ থেকে বিনিয়োগ বা বড় চুক্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো বাধা হবে না। তিনি বলেন, ‘চীন জানে, এই অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জনগণের পূর্ণ ম্যান্ডেট নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন।’

তিস্তা ইস্যুতে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার নিজস্ব স্বার্থে বেইজিংয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করা উচিত।

তিনি আগামী এপ্রিল মাসে ঢাকায় আয়োজিত বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখছেন।

জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোতে পারস্পরিক স্বার্থ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘উন্নত মানের চিকিৎসা সুবিধা প্রতিষ্ঠায় চীনের আগ্রহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’

আরও পড়ুনঃ  ‘স্বপ্নের’ আমেরিকা মানুষ ছাড়তে চাইছে কেন?

বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাব এনাম খান ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার এই সফরকে অন্য দেশের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন- রোহিঙ্গা সংকট ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

অধ্যাপক শাহাব এনাম খান আরও বলেন, এ সফর রোহিঙ্গা সংকট পুনর্বিবেচনার নতুন সুযোগ তৈরি করছে। কারণ ২০২৪ ও ২০২৫ সালে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন।

সম্ভাব্য ভ্রমণসূচি

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হাইনান প্রদেশে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে ২৬ মার্চ চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।

২৭ মার্চ তিনি সম্মেলনের উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন এবং চীনের নির্বাহী ভাইস প্রিমিয়ার ডিং জুয়েশিয়াং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।

২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা বেইজিংয়ের গ্রেট হল অফ দ্য পিপলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।

তিনি হুয়াওয়ের একটি উচ্চ প্রযুক্তির উদ্যোগ পরিদর্শন ও চীনের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ২৯ মার্চ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি সেখানে বক্তব্য দেবেন। এরপর ওই দিনই প্রধান উপদেষ্টার দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ