Wednesday, March 19, 2025

শেখ হাসিনার কথাই ছিল আইন, সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক তথ্য ফাঁস করলেন আ. লীগে প্রবীণ নেতারা

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। সম্প্রতি কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামলে নানা ত্রুটির কথা তুলে ধরে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তারই দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা।

সাক্ষাৎকারে ওই নেতারা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, শেখ হাসিনা তাঁর সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। যেসব মানুষ তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের তিনি রোষানলে ফেলেছেন। এছাড়াও শেখ হাসিনা আরও যা সহ্য করতে পারেন না, তা হলো তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সমালোচনা। শেখ হাসিনার শাসনকালে আওয়ামী লীগকে একটি পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত করার অভিযোগ উঠেছে।

আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা জানিয়েছেন, সত্য কথা বলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধচারণ করে কেউ দলে টিকে থাকতে পারেননি। এছাড়াও, ক্ষমতায় থাকার সময় শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালিয়েছেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তই সকলকে মাথা পেতে নিতে হয়েছে। তার ছোট বোন শেখ রেহানা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সহ পরিবারের সদস্যরাই ছিল তার কাছে সবকিছু। তারা পরিবারিক সদস্যদের জন্য অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য চিহ্নিত অপরাধী, মাফিয়া, দুর্নীতিবাজদের দলভুক্ত করতেন।

আরও পড়ুনঃ  তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আ.লীগ?

শেখ হাসিনা তোষামোদকারীদের এতটাই পছন্দ করতেন যে, বিভিন্ন সময় সংবাদ সম্মেলনে যারা তার পক্ষ নিয়ে প্রশ্ন করতেন, তাদের ভাগ্য এক নিমিষেই বদলে দিতেন।

এ প্রসঙ্গে এক সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, “আওয়ামী লীগের এই পরিণতির জন্য এককভাবে শেখ হাসিনাই দায়ী। তিনি ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করেছেন। অবমূল্যায়ন করতেন। অপমান-অপদস্ত করতেন। দলে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার কথাই ছিল শেষ কথা। তার কথাই ছিল আইন। তিনি নিজেকে রাজা ভাবতেন, আর দেশের মানুষকে ভাবতেন প্রজা। ভিন্নমত একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না শেখ হাসিনা। আর এ কারণেই তাকে এভাবে চোরের মতো পালাতে হয়েছে।”

১৯৮১ সালে দিল্লিতে দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন শেষে ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। বিদেশে অবস্থান করার সময়ই ওই বছরের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৩ দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের হাল ধরেই শেখ হাসিনা দলের পরীক্ষিত এবং ত্যাগী নেতাদের একে একে দূরে সরাতে থাকেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর ছিলেন দেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ছিলেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং দলটির সভাপতি করার পেছনে ড. কামাল হোসেনই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। কিন্তু শেখ হাসিনা ৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর সবার আগে তাকেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন। শুধু ড. কামাল হোসেন একা নন, আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ-নবীন নেতাকে শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে করুণ পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসবে বিএনপি

শুধু ড. কামাল হোসেন একা নন, আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ-নবীন নেতাকেও শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলায় সেসময়ের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি পর্ষদের সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়াও, ১৯৯৯ সালে একইভাবে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয় তার ছোটভাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে।

শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে ছাত্রলীগের এক সময়কার তুখোড় নেতা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকেও আওয়ামী লীগ ছাড়তে হয়।

শেখ হাসিনাকে তোষামোদি করতে না পারায় আমৃত্যু দলে উপেক্ষিত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে। তাদের সন্তান তানজিম আহমদ সোহেল তাজও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করতে পারেননি। শেখ হাসিনার আরেক ফুপাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ শেখ পরিবারের অনেকে পরোক্ষভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। সোহেল তাজ এর বিরোধিতা করলে শেখ সেলিমের সঙ্গে তুমুল বিরোধ জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু শেখ হাসিনা সঠিক প্রতিকার না করায় শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ আর অভিমানে দল ছাড়েন নবীন এই নেতা। তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আমৃত্যু উপেক্ষিত ছিলেন আওয়ামী লীগে। শেখ হাসিনাও কখনোই তাদের অবদান স্বীকার করেননি।

আরও পড়ুনঃ  ছাত্রশিবিরের নামে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্কতা

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ ও শেখ হাসিনার ক্রোধে পড়েন। এমনকি ৭৫-পরবর্তী ১৫ আগস্টে পরেও তিনি শেখ হাসিনা তার ভূমিকা নিয়ে কলাম লিখেছিলেন। আওয়ামী লীগের আরেক প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও শেখ হাসিনার রোষানলে পড়তে হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৫৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে যে আওয়ামী লীগ এর যাত্রা শুরু হয়, সেই দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে ততটা গুরুত্ব দেননি শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা শেখ মুজিবুর রহমানকে সব কৃতিত্ব দিতে চান, আর এজন্য তিনি প্রথম মেয়াদে ৫ বছর এবং পরবর্তী ১৫ বছরের শাসনামলে নিজের, বাবা-মা, ভাই-বোন এবং আত্মীয়স্বজনের নামে নানা প্রতিষ্ঠান নামকরণ করেন, কিন্তু ওইসব জাতীয় নেতাদের নামে তিনি কিছুই করেননি।

সর্বশেষ সংবাদ