রাজনীতির টেবিলে এখন এক নিঃশব্দ আলোচনার নাম—ডা. জোবাইদা রহমান। খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা ও তারেক রহমানের দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বিএনপির নেতৃত্ব-শূন্যতার বাস্তবতা যতই স্পষ্ট হয়েছে, দলটির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে ততই গুঞ্জন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী ৫ মে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশে ফিরছেন তার পুত্রবধূ, ‘নন-পলিটিক্যাল’ মুখ ডা. জোবাইদা রহমান। রাজনৈতিক মহল জিজ্ঞেস করছে—তবে কি জোবাইদা রহমান হচ্ছেন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক বিকল্প?
জন্মসূত্রের পরিচয় বনাম জনসম্পৃক্ততা
ডা. জোবাইদা রহমান মূলত পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি প্রয়াত সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমানের কন্যা এবং তারেক রহমানের সহধর্মিণী। তার রাজনৈতিক পরিসরে কোনো সরাসরি কার্যক্রম বা জনসম্পৃক্ততা নেই, এমনকি বিএনপির কোনো পদেও তিনি নেই। অথচ তাকে ঘিরেই দলের ভেতরে-বাইরে একটি সম্ভাব্য ‘মোড় ঘোরা’র ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতিতে নামছেন কী জোবাইদা রহমান নাকি তারেক রহমানের দেশে ফেরার আগে পরিস্থিতি অবজার্ভ করতে আসছেন তিনি। ইতোমধ্যে তার নিরাপত্তা চেয়ে আইন শৃঙ্খলার বিভিন্ন দফতরে দেয়া হয়েছে চিঠি। জোবায়দা রহমানের নিরাপত্তা ‘নিশ্চিত করতে’ পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) চিঠি দিয়েছে বিএনপি। চিঠিতে তার বাসভবনের পাশাপাশি বাইরে চলাফেরার ক্ষেত্রেও ‘গাড়িসহ পুলিশি নিরাপত্তা’ চাওয়া হয়েছে। জোবাইদা রহমান ধানমন্ডিতে তার বাবার বাড়িতে উঠবেন জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের স্ত্রী হিসেবে তার জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। “সে কারণে তার ঢাকার বাসায় অবস্থানের সময় এবং যাতায়াতের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।” এই নিয়েই অনেকে বলছেন—তিনি তো এখনো রাজনীতির মাঠে পা রাখেননি, তবে কেন তাকে নিয়ে এত প্রস্তুতি?
‘দল’-এর ভেতরে নতুন রণকৌশল?
বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তারেক রহমানের ওপর রয়েছে এক ধরনের অদৃশ্য রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। এই শূন্যতার জায়গায় জোবাইদাকে সামনে এনে দল অন্তত একটি ‘পরিবারকেন্দ্রিক গ্রহণযোগ্যতা’ তৈরি করতে চায়।
একজন জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা বলেছেন, “দলটি যেহেতু আবেগ ও বিশ্বাসভিত্তিক, তাই নেতৃত্বের পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও পরিবারকেন্দ্রিক স্বীকৃতি জরুরি। জোবাইদার নাম কর্মীদের মধ্যে একধরনের আশার প্রতীক।”
‘সিস্টেম’ বনাম ‘সেনসিটিভ সিগন্যাল’ তবে একে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলা যাচ্ছে না এখনই। এই সিদ্ধান্ত একাধারে কৌশলগত, আবেগনির্ভর, এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি প্রতিক্রিয়ামূলক। বিশ্লেষকদের মতে, এ যেন দুই কুল রাখার কৌশল। রাজপথে না নেমেই একটি মুখ সামনে রাখা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন “এটা বিএনপির জন্য একধরনের ‘সেনসিটিভ সিগন্যাল’। যেখানে দল তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রশ্নে জেনারেশনাল ট্রান্সফার শুরু করতে চায়, কিন্তু প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে চাইছে না।”
আইনি বাধা, যাত্রার আগেই কাঁটা: জোবাইদা রহমান ২০০৮ সালের দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। যদিও হাইকোর্ট সেটি স্থগিত করেছে, তা সত্ত্বেও আইনি ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, এসব মামলা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিএনপি ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে তার নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেছে। চার স্তরের নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এই নিরাপত্তা চাওয়াকে ‘অঘোষিত নেত্রী হিসেবে’ সামনে আনার ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ফোরণ: ‘নতুন ম্যাডাম’: ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং রাজনৈতিক চ্যাট গ্রুপগুলোতে গত এক সপ্তাহ ধরে একটি নাম নিয়েই আলোড়ন—জোবাইদা রহমান। কেউ লিখছেন, “নতুন ম্যাডাম আসছেন”, কেউ বলছেন “পরিবারবাদেই বিএনপি আটকে আছে।” আবার অনেকে বলছেন—এটাই নতুন প্রজন্মের জন্য একধরনের ‘ট্রান্সিশনাল লিডারশিপ’।
তবে আশঙ্কাও রয়েছে। দলের কিছু নেতা ও বিশ্লেষক মনে করছেন, মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা না থাকলে তা দুর্বলতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। মাঠের রাজনীতি বক্তৃতা, সমাবেশ আর প্রতিরোধের ক্ষমতা চায়—এটা নিছক পরিচয়ের জোরে টেকানো যায় না।
গোপন প্রস্তুতি, নাকি নেতৃত্ব হস্তান্তরের সূচনা?
জানতে চাওয়া হলে দলের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ কেউ বলেন—“এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যা বলবেন, সেটাই হবে। তবে তারেক রহমান সাহেবের অনুপস্থিতিতে ‘বিশ্বাসযোগ্য মুখ’ দরকার।” আর সেই মুখ হিসেবেই ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছেন জোবাইদা।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেদ হোসেন আলাল আরটিভিকে জানান, ডা. জোবাইদা রহমান দেশে ফিরবেন এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ফ্যাসিবাদ সরকার তাকে এতো বছর দেশে ফিরতে দেয়নি, মিথ্যে মামলা দিয়েছেন, সেই জাল ছিড়ে ফ্যাসিবাদ মুক্ত দেশে ফিরছেন জোবাইদা রহমান। কারাগার থেকে মুক্ত হলে যেমন অনুভূতি হয়, তারও তেমন অনুভূতি নিশ্চিই, নিজ দেশে ফিরছেন। আপাতত রাজনৈতিক কোন কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার কোন খবর নেই আমাদের কাছে। আর তিনি যদি মনে করেন রাজনীতিতে তার প্রয়োজন আছে, সে রাজনীতিতে যুক্ত হতেই পারে। তাতে করে দলের নেতাকর্মীরা অখুশি হবেন না বরং খুশিই হবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ আরটিভিকে জানান, খালেদা জিয়া ফিরবেন, সাথে তাদের দুই পুত্রবধূ ফিরবেন। তাদের নিরাপত্তা কেমন হবে তা নিয়ে আমাদের সিকিউরিটি মিটিং হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে একটা বড় রিসিপশনের চেষ্টা করছি। তারাদের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। আপাতত এটুকুই। পরে কি হবে সেটি জানতে পারবেন।
বিএনপির টার্নিং পয়েন্ট?
ডা. জোবাইদা রহমান এখনো একটি ‘রাজনৈতিক চরিত্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেননি। কিন্তু সময়ের দাবি, রাজনৈতিক শূন্যতা, এবং পারিবারিক আস্থা তাকে একটি প্রতীকী অবস্থানে দাঁড় করাচ্ছে। তিনি সামনে এলে বিএনপির রাজনীতিতে শুরু হতে পারে নতুন অধ্যায়। কিন্তু সেটি হবে চ্যালেঞ্জে ভরা—দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, রাজপথে ফেরানো, ও নতুন প্রজন্মের আস্থা অর্জনের পরীক্ষা। এখন প্রশ্ন—জোবাইদা কি শুধু একজন পুত্রবধূ? নাকি ভবিষ্যতের এক অনিবার্য নাম?